বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের লড়াইয়ের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন সামরিক স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের মধ্য
দিয়ে ১৯৮৫ সালের ১০ জানুয়ারি গঠিত হয়

সালটা ১৯৮৫, দিনটা ১০ জানুয়ারি। দেশ তখন এরশাদের স্বৈরাচারী শোষণের কবলে। রাজনীতির মধ্যে বিরাজ করছিল চরম হতাশা। ছাত্র রাজনীতিও একইভাবে লেজুরবাদীতায় লিপ্ত ও দিশাহীন। সেরকম এক ক্রান্তিলগ্নে ‘বুর্জোয়া লেজুরবাদী রাজনীতির বিপরীতে শ্রমিকশ্রেনীর রাজনীতি বিকাশে সহায়ক ছাত্ররাজনীতি’ বিকাশের লক্ষে জন্ম নিয়েছিল বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন।

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দেশের প্রত্যেকটি ছাত্র আন্দোলনে ও গুরুত্বপূর্ণ সকল জাতীয় সংগ্রামেও এই ছাত্র সংগঠনটির ছিলো লড়াকু ভূমিকা। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গোলাম আজমের বিচারের দাবীতে গড়ে ওঠা ৯২’এর আন্দোলন, জাহাঙ্গীরনগর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলন’, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামসুননাহার হলে পুলিশী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার বাণিজ্যকীকরণবিরোধী আন্দোলন, ওসমানী উদ্যানের গাছ রক্ষা আন্দোলন, ফুলবাড়ির ‘কয়লা খনি’ আন্দোলন, টিপাইমুখ বাধ বিরোধী আন্দোলন, ২০-২২ আগষ্টের ছাত্র আন্দোলন, সুন্দরবন ধংসকারী রামপাল তাপবিদ্যুত কেন্দ্র বাতিলের আন্দোলন, বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে ধারাবাহিক আন্দোলন, মার্কিন সাম্রায্যবাদের স্বার্থে তথাকথিত বাণিজ্য চুক্তির নামে দেশধংসের ‘টিকফা’ চুক্তির বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলন, শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি ও নিরাপদ কর্মপরিবেশের দাবীসহ বিভিন্ন ইস্যূতে গড়ে ওঠা শ্রমিক আন্দোলনসহ শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষার সমস্থ লড়াই সংগ্রামে ছাত্র ফেডারেশন সাধ্যমত লড়াকু ভূমিকা পালন করে চলছে।

 

চলমান ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়েও বাংলাদেশ তার সাধ্যের সর্ব্বোচ্চটুকু নিয়ে লড়াইয়ের ময়দানে হাজির ছিলো। ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামকে অধিকতর শক্তিশালী করতে ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র ঐক্য গঠনে বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বাংলোদেশে বর্তমান ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের লক্ষ্যে আমরা আমাদের সাধ্যের সবটুকু দিয়ে আমাদের লড়াই চালিয়ে  যাচ্ছি।

জাতীয় সম্পদ রক্ষার আন্দোলনে বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন বরাবরই লড়াকু ভূমিকায় থেকেছে, আছে। জাতীয় সম্পদ রক্ষার সংগ্রামকে বেগবান করতে ঘেরাও, হরতালের মতো কঠোর কর্মসূচী পালন করতে গিয়ে নগ্ন রাষ্ট্রীয় নিপীড়ণের শিকার হয়েছে ছাত্র ফেডারেশনের বহু নেতা-কর্মী। বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে ২০১২ সালের ৩০ ডিসেম্বর ‘জ্বালানী মন্ত্রণালয় ঘেরাও’ কর্মসূচীতে ছাত্র ফেডারেশনের সাবেক কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদককে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর গুলি পর্যন্ত সহ্য করতে হয়েছে। সারাজীবন সেই ক্ষতি তাকে বয়ে বেড়াতে হবে।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কাঠামো এমনকি তথাকথিত প্রগতিশীল চিন্তাকাঠামোর মধ্যেও যে পুরুষতান্ত্রিক উপাদান হাজির আছে তার বিরুদ্ধেও ছাত্র ফেডারেশন সংগ্রাম জারি রেখেছে। তথাকথিত প্রগতিশীল রাজনৈতিক চর্চার মধ্যেও পুরুষতান্ত্রিক চর্চা ছিল, এখনো আছে। বিক্ষোভ মিছিলেও নারীকে ‘শোভাবর্ধক’ আকারে সামনের সারিতে রাখার চর্চার বিপরীতে বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনই প্রথম নারীকে ‘সংগ্রামী মানুষ’ হিসেবে দেখার রাজনৈতিক চর্চা শুরু করেছে। 

২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে ব্যাপক ‘গণজাগরণ’ সৃষ্টি হয়েছিল। যে স্পিরিট বুকে নিয়ে সেই জাগরণ ঘটেছিল, সেই স্পিরিট ৭১’ থেকেই বাংলার মানুষ যেভাবে ধারণ করে চলেছে, ছাত্র ফেডারেশনও সেই রকম গভীরভাবেই ধারণ করে। ২০১৩ সালের গণজাগরণেও ছাত্র ফেডারেশন ‘গণজাগরণ মঞ্চ’র বিভিন্ন সমালোচনা, পর্যালোচনাসহ তার র‌্যাডিক্যাল ভূমিকা পালনে সচেস্ট ছিল।

 

 

সংগ্রামের এই ধারাবাহিকতা ও রাজনীতির নানারকম চড়াই-উতরাই পেড়িয়ে ছাত্র সংগঠনটি দেশের অন্যতম প্রধান ‘রাজনীতি নির্ধারক’ ও শ্রমিক শ্রেনীর সহায়ক ছাত্র সংগঠন আকারে হাজির হতে পেরেছে, লড়াই-সংগ্রাম জারি রেখেছে । শুধু শ্রমিক আন্দোলনেই নয়, শ্রমিক বন্ধুদের মানবিক বিপর্যয়েও ছাত্র ফেডারেশন জীবন বাজি রেখে পাশে দাড়িয়েছে, রানা প্লাজার উদ্ধার তৎপরতা এবং পরবর্তীতে তাদের আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য সহযোগিতামূলক কর্মকান্ড এবং তাদের রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত করতে ছাত্র ফেডারেশন আপ্রাণ চেস্টা করেছে, এখনো করছে। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধেও জারি রেখেছে তুমুল সংগ্রাম।

জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে একটি উৎপাদনমুখী, সার্বজনীন, মাতৃভাষায় বিজ্ঞানভিত্তিক, সবার জন্য অভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবিতে শিক্ষা আন্দোলন করে যাচ্ছে বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন। ছাত্র আন্দোলনের পাশাপাশি বিভিন্ন জাতীয় ইস্যূতে বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন গণসংহতি আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে জাতীয় রাজনৈতিক সংগ্রাম করে চলছে।

‘মুক্তিযুদ্ধে জনগণের আকাঙ্ক্ষার রাষ্ট্র ও সংবিধান’ ও একটি আত্নমর্যাদাসম্পন্ন, সার্বভৌম ও জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম আমরা জারি রেখেছি। আমাদের আশু দাবি ‘গণতান্ত্রিক সংবিধান’ প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক সংগ্রাম। এই সংগ্রামগুলো ছাড়া দেশের জাতীয় মুক্তি সম্ভব নয়।

জাতীয় মুক্তির এই সংগ্রামকে আমরা পরিচালিত করতে চাই শোষণের রাষ্ট্র উচ্ছেদের সংগ্রামের রক্তিম পথে। নির্মাণ করতে চাই একটা সত্যিকারের শ্রেনী বৈষম্যহীন মানবিক সমাজ।