সোশ্যাল মিডিয়া ’ফেসবুক’ এখন ভয়াবহ এন্টিসোশ্যাল

ফেসবুকের উপর দিনদিন বিতৃষ্ণা চলে আসছে। এতটা টক্সিসিটি, সামনা সামনি হাসাহাসি করা মানুষগুলা ফেসবুকে ভয়াবহ নেগেটিভিটি ছড়ায়। এই জঞ্জাল থেকে নিজেরে যতই দূরে রাখার চেষ্টা করি না কেন, এখানে ঢুকলেই অবচেতন মনকে মানুষবিদ্বেষী, প্রতিক্রিয়াশীল করে তোলার জন্য ফেসবুক অনবরত গুঁতাতে থাকে। আর রাজনীতির নামে এই প্ল্যাটফর্মটারে ভয়াবহ এক্সপ্লয়েট করা হচ্ছে। রাজনীতির কাজ তো ভাই এটা না! আমার সাথে কারো কথা হলে আমি কালচারাল পুলিশিং এর পরিবর্তে ঘটনার পেছনের পলিটিক্সকে সামনে নিয়ে আসার ব্যাপারে বেশি গুরুত্ব দিই। ফেসবুক নিয়ে অসংখ্য সার্ভেতে দেখা গেছে এই প্ল্যাটফর্মটা-
১) জাতিবিদ্বেষ, ধর্মবিদ্বেষকে উস্কে দেয়। মায়ানমারে রোহিঙ্গা নিধনের প্রজেক্টে জনমত তৈরি করার জন্য মায়ানমার জান্তা ও বুদ্ধিস্ট মঙ্করা ফেসবুককে ব্যবহার করছিল। মায়ানমারের ঘটনা ethnic cleansing কে ধর্মীয়+ জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে জাস্টিফাই করার একদম টেক্সটবুক উদাহরণ। আরেকটা হচ্ছে ভারতের রাজনীতিতে হিন্দুত্ববাদী প্রচারণা। অহরহ ভারতে হোয়াটস এপকে ফেক নিউজ ছড়ানোর টুল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তাই ফেসবুকের মতো প্ল্যাটফর্মকে সহজেই প্রতিক্রিয়াশীল আর ঘৃণাজীবী রাজনীতির জমিন তৈরি করার জন্য ব্যবহার করা যায়। এমনকি ডোনাল্ড ট্রাম্পের নারীবিদ্বেষী ইমেজকে হোয়াইট ওয়াশ করার জন্য ফেসবুককে খুব চতুরভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

২) লিঙ্গীয়বিদ্বেষ আর সহিংসতাকে উস্কে দেয়। আমরা ফেসবুকের Reels আর videos section দুইটাতে গেলে দেখব আমরা যে ধরনের ভিডিও দেখতে পছন্দ করি সে ধরনের ভিডিও আমাদের কাছে আসে। মাঝেমাঝে সাজেশন হিসেবে ভয়াবহ নারীবিদ্বেষী আর অসুস্থ কন্টেন্টও আমার এখানে আসে। হয়তো এসব ভিডিওতে মেয়েদের নাচের reels নিয়ে নাইলে কোনো টিপ পড়া বা সিগারেট খাওয়া মেয়েদের ক্যারেক্টার এসাসিনেশনের ভিডিও, নায়িকাদের নিয়ে ভিডিও। ঐ ভিডিওগুলার কমেন্ট সেকশন চেক করলে আমি হতভম্ব হয়ে যাই, সাথে অজস্র লাইক। কিন্তু আমার অবাক লাগে যে আমি তো এই ধরনের কন্টেন্টের কনজিউমার না, তাইলে আমার কাছে এসব কেন আসল? তার মানে তো এই প্ল্যাটফর্মে নানান মানুষের কাছে এ ধরনের কনটেন্ট যেতে থাকে। অনেকটা বরশি দিয়ে মাছ ধরার মতো। টোপ ফেলে দেখে কারা নারীবিদ্বেষী কন্টেন্ট কনজিউম করতে পছন্দ করে। এদের বেশিরভাগ প্রোফাইলে আবার কোরআনের আয়াত থাকে, Free Palestine এর স্লোগান থাকে। অনেকে ছেলেদের কমেন্টে শরিফ থেকে শরীফা বিষয়ে হাসিঠাট্টা করতে পছন্দ করে।

৩) ফেসবুক রাজনৈতিক পোলারাইজেশন তৈরি করার সবথেকে বড় মাধ্যম। আর যেহেতু ফেসবুক জাতি, ধর্ম, নারীবিদ্বেষী কন্টেন্টকে অধিক প্রচার করে তাই এই টুলের হাত ধরে পজিটিভ পলিটিকাল ভয়েসের সামনে আসাটা কঠিন। বরং hate speech গুলোই অনবরত সার্কুলেট হতে থাকে আর অজস্র ফেসবুক সেলিব্রেটি, ফেসবুকে জাতিবিদ্বেষ প্রচার করে বেড়ানো নেতাদের স্পিচকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। যেহেতু নেগেটিভ কনটেন্টের ভিউ বেশি হয় তাই নেগেটিভ কন্টেন্টের পরিমাণও বাড়তে থাকে, আবার নেগেটিভ কন্টেন্ট যত বাড়তে থাকে তত পজিটিভ কন্টেন্ট চাপা পড়তে থাকে।

এখানে ফেসবুকের মনিটরিং সিস্টেম নিয়ে একটু কথা বলা দরকার। ফেসবুক মনিটরিং এর জন্য দক্ষিণ এশিয়ার মনিটরিং এর উপর এতটা জোর আরোপ করে না। যেহেতু ইউরোপ, USA তে ফেসবুকের উপর বিধিনিষেধ বেশি তাই সেসব দেশের human rights, hate speech and misinformatiom combat করার জন্য ফেসবুক অনেক সচেষ্ট থাকে। ২০১৯ এ ফেসবুকের একজন whistle blower এর দেয়া তথ্যমতে, ফেসবুক content regulation এর নির্ধারিত বাজেটের ৮৭% english speaking দেশগুলাতে ব্যবহার করে। অথচ ওর ইউজারদের ৯% মাত্র english speaker। অর্থাৎ, এশিয়া, যেখানে তার ইউজার সবথেকে বেশি সেখানে ফেসবুকের regulation এর বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। উল্টা এই টুলটা hate speech ছড়ানোর উৎকৃষ্ট মাধ্যম হিসেবে সফলভাবে ব্যবহার হচ্ছে। সবথেকে ভয়ানক ব্যাপার আমাদের দেশগুলাতে ফেসবুকের কন্টেন্টের নিয়ন্ত্রণ পুরাটাই সরকারে হাতে হয়ে থাকে। যেহেতু ফেসবুকের কন্টেন্ট কোনো সেন্ট্রাল বডির মাধ্যমে তত্ত্বাবধান করা হয় না, বরং পৃথিবীকে বিভিন্ন জোনে ভাগ করে জোনগুলাকে এই তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দেয়া হয় তার কারণে Region গুলার পলিটিকাল হিসাব নিকাশ এখানে ফেসবুকের কন্টেন্টের ফ্লো নিয়ন্ত্রণের সবথেকে বড় নির্ধারক হয়ে পড়ে। পলিটিক্স মানেই প্রধানত দেশগুলার সরকারের হাতে কন্টেন্ট নিয়ন্ত্রণের পুরা ক্ষমতা চলে আসে। কি ভয়াবহ! একটা একনায়ক সরকার তাহলে কি করবে?! নিশ্চয়ই ফেসবুকের জনমত এমনভাবে তৈরি করবে যাতে তার ক্ষমতা টিকায় রাখা যায়?! যার ফলে এখানে বাঙালি মেট্রোরেলে চড়ে উন্নয়নের হাওয়াও খায়, আবার ফেসবুকে মেয়েদের জন্য আলাদা বগি থাকতে কেন জেনারেল বগিতে উঠবে বলেও গলা ফাটায়, free palestine বলেও উত্তেজিত হয়, দেশটারে আওয়ামী লীগ ইন্ডিয়ার কাছে বেচে দিল বলে বলে বিলাপ করে, আবার দেশে মুসলিমরা বিপদে আছে বলে উত্তেজিত হয়। এই পক্ষটা সরকারবিরোধী কিন্তু সেও মনে মনে প্রগতিশীল, নাস্তিক, টিপ পড়া, রং খেলা বর্গদের অবদমন করে আরেকটা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র কায়েম করার খায়েশ রাখে। এই উত্তেজনা দেখে আরেক পক্ষ আবার হায় হায় করে ফ্যাসিবাদের ছায়াতলে আশ্রয় খুঁজে, হাতকাটা ব্লাউজ পড়ার স্বাধীনতা আর জান-জবানের স্বাধীনতাকে একিভূত করে ফেলে। এভাবে ফেসবুক একটা ভয়াবহ টক্সিক স্পেসে পরিণত হয়। তার ভিত গভীর হয় আর দেশের আপামর জনগণ একটা এক্সপেরিমেন্টে পরিণত হয়। বহু কন্টেন্ট ক্রিয়েটর এই জনগণের সরকারবিরোধীতারে পুঁজি করে নিজের আখের গুছাতে থাকে আর কন্টেন্টের জন্য মানুষরে অনিবার্য সংঘাতের মুখে ফেলে রেখে যায়। অনেকে মনে করে, এই আপামর মুসলিম জনগোষ্ঠী টাইম বোমার মতো ফুটে ফ্যাসিবাদ আর ভারতীয় আধিপত্যবাদরে ভাসায়ে নিয়ে যাবে, আর ইসলামের ছায়াতলে এই জনপদ তার আশ্রয় খুঁজে পেতে সক্ষম হবে। এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। এই সেই টাইমবোমা যেটা টিক টিক করে কিন্তু ফাটে না। বরং টাইমবোমা ফাটবে এই ভয় দেখায়ে পাশের দেশ হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির রাস্তা পরিষ্কার করে। এপ্রিলে ভারতের ইলেকশন। ভারত রিসেন্টলি ইলেকটোরাল বন্ডের স্ক্যাম নিয়ে তোলপাড় হয়ে আছে। হাজার চেষ্টা করেও বিজেপি শাক দিয়ে এই মাছটাকে ঢাকতে পারেনি। আর বাংলাদেশে প্রবল ভারতবিদ্বেষী কিন্তু জগাখিচুড়ি মতামতরে ফেসবুকের থ্রু ব্যাপক হাওয়া দেয়া হচ্ছে। ভারতের এপ্রিল মাসের ইলেকশনের পর ভারতবিরোধীতার পলিটিক্সটার গতিমুখ কেমন হয় সেটা না দেখে আগাম সিদ্ধান্তে আসা একদমি ঠিক হবে না। কিন্তু ফেসবুক এই সংঘাত তৈরির সবথেকে বড় টুল হিসেবে ইউজ করছে বিভিন্ন অংশ। কিন্তু এটা বুঝতে হবে যে এই প্ল্যাটফর্ম দুইটা পোলের বিদ্বেষরে আশ্রয় দিলেও সন্ধি করার পক্ষ তৈরি হতে দিবে না সহজে। ফেসবুক মেকানিজমের কারণেই এটা সম্ভব না। তাই ফেসবুকের উপর ভরসা কমিয়ে আবার জনগণের কাতারে নেমে আসলে, অর্থাৎ অনলাইন পথের তুলনায় অফলাইন পথে মনোযোগ দিলে ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

যতই বলি না কেন যে ফেসবুককে সিরিয়াসলি নেয়ার কিছু নাই, আসলে সিরিয়াসলি নেয়ার আছে। সামনাসামনি যে মানুষ আপনার সাথে হাসিঠাট্টা করে, সবথেকে আপন হয়ে ওঠে ফেসবুকে সে ট্রোল করছে আর নাইলে হেটস্পিচ ছড়াচ্ছে। এই যে মানুষের আদি দ্বিচারি স্বভাব এটা অনলাইনে আরো জঘন্য রূপ লাভ করে। ফেসবুকে মানুষ মানবিক গুণ গুলারে ড্রেনে ফেলে ভয়াবহ বিদ্বেষ ছড়াতে পারে কোনো প্রকার সামজিক বিরোধিতা ছাড়াই। সামান্যতম না চিনেই ভিন্ন চিন্তা, ভিন্ন লিঙ্গ, ভিন্ন শ্রেণি, ভিন্ন জাতির মানুষের ব্যাপারে কথা ছড়াতে পারে। তাহলে এটা আর সোশাল মিডিয়া থাকল কই। এটা তো ভয়াবহ এন্টি-সোশাল মিডিয়া। ফেসবুকের এলগরিদমগুলারে আরেকটু বেটার জানলে বুঝলে হয়তো আমরাও নিজেদের এবং আশপাশের মানুষদের এটার ফাঁদে পা দেয়া থেকে আটকাতে পারব।

 

উমামা ফাতেমা 

সদস্য সচিব, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *